site-logo

www.bdedition.com

(অনলাইন বাংলা নিউজ পোর্টাল)

শিল্প-সাহিত্য
অনাচার শোষণের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার
প্রকাশিত: আরিফুল ইসলাম 27 মে 2025, 02:32 দুপুর
news-banner

‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক’Ñ কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই অমর পঙ্‌ক্তিমালা তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। আজও কবি নজরুল বাঙালির হৃদয়ে শান্তি, সম্প্রীতি ও সাম্যর বার্তাবাহী অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ‘চির উন্নত’। 

মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। শোষণ-বঞ্চনা ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং নারী-পুরুষের সমতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং গানের ‘বুলবুল’খ্যাত দ্রোহ-প্রেম ও মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬তম জন্মবার্ষিকী।

‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : কাজী নজরুলের উত্তরাধিকার’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যে এবার উদযাপিত হচ্ছে কবির জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় এবং কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হবে এবারের নজরুলজয়ন্তীর মূল অনুষ্ঠান। আলোচনা, নজরুল পুরস্কার প্রদান এবং ‘চেতনা ও জাগরণে নজরুল’ শীর্ষক নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটকসহ নানা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় সাজানো এই আয়োজন শুরু হবে আজ বেলা ৩টায়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

এছাড়া দিনটি উপলক্ষে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের আয়োজনে দুই দিনব্যাপী ‘নজরুল-উৎসব ১৪৩২’, বাংলা একাডেমি আয়োজনে দিনব্যাপী নজরুল বিষয়ক সেমিনার ও নজরুল পুরস্কার প্রদান এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সাংস্কৃতিককর্মী সংঘের আয়োজনে রয়েছে দুদিনের নজরুল উৎসব। 

ছায়ানট মিলনায়তনে আজ রবিবার সন্ধ্যা ৭টায় একক ও সম্মেলক গান, নৃত্য, পাঠ-আবৃত্তি দিয়ে সাজানো সকলের জন্য উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পী ছাড়াও আমন্ত্রিত শিল্পী ও দল অংশ নেবেন। একই সময়ে রাজধানীর সেগুনবাগিচার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে শুরু হবে সাংস্কৃতিককর্মী সংঘের দুদিন নজরুল উৎসব। 

আজ সকাল সাড়ে ৬টায় জাতীয় কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শুরু হবে বাংলা একাডেমির আয়োজন। বিকাল ৪টায় একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে সেমিনার, নজরুল পদক প্রদান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)-সহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে প্রচার হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

কাজী নজরুল ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানাধীন চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন। তার ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। শৈশবেই পিতৃহারা পরিবারের ভরণপোষণের জন্য মক্তব, মসজিদ ও মাজারের খাদেমের কাজ করতে হয় তাকে। বাল্য বয়সেই যোগ দেন লেটো দলে। লেটো দলেই তার সাহিত্যচর্চা শুরু। এই দলের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যেতেন, অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। পরবর্তীতে যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। সৈনিক থাকাবস্থায় অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় ফিরে থাকতে শুরু করেন কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে। এখান থেকেই শুরু সাহিত্য-সাংবাদিকতাসহ জীবনের মূল কাজগুলো। 

বাংলা সাহিত্যে কবিরূপে নজরুলের আবির্ভাব কেবল ধূমকেতুর সঙ্গেই তুলনীয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ মাত্র একুশ বছর বয়সে ১৯২১ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের ভিত নাড়িয়ে দেন। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে আর গণমানুষের নিপীড়ন, বৈষম্য, শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে লিখেছেন। তার লেখার পরতে পরতে উঠে এসেছে তৎকালীন ভারতবর্ষের মুক্তির দাবি। পাশাপাশি সাম্যের বাঁধন আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা। সত্যের পক্ষে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলার বিস্ময়কর ক্ষমতা লালন করতেন বলে হয়ে উঠেছিলেন অন্যায়-অবিচার, দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মূর্ত প্রতীক।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তার কাব্য সংকলন ‘অগ্নিবীণা’। এ ছাড়া তিনি দুহাতে লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ। তবে তার সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো গান। তার লেখা গান ‘নজরুলগীতি’ নামে পরিচিত; তবে বর্তমানে নজরুলসংগীতও বলা হয়। তিনি তিন হাজারেও অধিক গান রচনা করেছেন। এসব গানের বড় অংশই তার নিজেরই সুরারোপিত। গান রচনাকালে তিনি ১৯টি রাগেরও সৃষ্টি করেন। তার রচিত ‘চল চল চল, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসংগীত।

১৯৪২ খ্রিস্ট্রাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীতে তাকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে পাঠানো হলে জানা যায় পিকস ডিজিস নামক একটি নিউরনঘটিত সমস্যায় আক্রান্ত। এই রোগে আমৃত্যু তাকে বাকশক্তিহীন ও মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে কাটাতে হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২৪ মে তাকে সপরিবারে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসে এবং জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা দেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। ধ্যানে-জ্ঞানে, চিন্তা-চেতনায় পুরোদস্তুর অসাম্প্রদায়িক কবি কাজী নজরুল ইসলাম দুই বাংলায় সমভাবে আদৃত।