
৫ আগস্টে শেখ হাসিনার পলায়ানোর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বাগেরহাট-৪ আসনে (মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলা) এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজির জন্য বাহিনী গড়ে তুলেছেন খায়রুজ্জামান শিপন (শিপন কাজী)। শতশত বিঘা মাছের ঘের শিপন কাজী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে দখলের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, প্রশাসন, সরকারি অফিস-সবই শিপনের নিয়ন্ত্রণে। তার রোষানলে পড়ে বিএনপির ত্যাগী অনেক নেতা-কর্মীও এলাকা ছাড়া। শেখ হাসিনা পতনের পর গত বছরের ১২ আগস্ট দেশে ফিরেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে মোড়েলগঞ্জ-শরণখোলায় গড়ে তুলেছেন এক প্রকারের ত্রাসের রাজত্ব। এমন কি, কোথায় কী হবে সবই ঠিক করে দেন শিপন কাজী। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেই প্রতিপক্ষকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ ট্যাগ দিয়ে মোবাইলে প্রাণনাশের হুমকি এবং হামলা-মামলা ভয়ভীতি দেখায়।
সম্প্রতি চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগে শিপন কাজীকে দ্বিতীয় দফায় শোকজ করেছে তার দল বিএনপি। শিপন বাগেরহাট জেলা বিএনপির সদস্য।
বাগেরহাট-৪ আসন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাকে লিজ দিয়েছেন এবং স্বয়ং খালেদা জিয়া বললেও কাজ হবে না- শিপন কাজীর এমন একটি অডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর মোড়েলগঞ্জের জিউধরা ইউনিয়নের শনিরঝোর-ডেওয়াতলা এলাকায় তানিয়া ইসলামের নামে থাকা ৬০ বিঘা এবং ১৫ বিঘার দু’টি মাছের ঘের দখল করে নিয়েছেন তিনি ও তার সহযোগীরা।
তানিয়ার অভিযোগ, শিপন অনুসারীরা অস্ত্রের মুখে তার কাছ থেকে জমির লিজ চুক্তিনামায় সই করে নিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে ইতোমধ্যে নগদ ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ হাজার টাকা ব্যাংক থেকে বিকাশের মাধ্যমে দিয়েছি। তিনটি ঘেরে প্রায় ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে নিজস্ব জমিতে ঘের করে আসছেন তার পরিবার। ঘের দখলের ঘটনায় শিপন কাজী ও তাদের সহযোগীদের নামে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, বাগেরহাট জেলা বিএনপি ও পুলিশ প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো ঢাকার তিনটি থানায় আমার নানা ও দুই মামার নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে শিপন কাজীর সহযোগীরা।
জিউধরা ইউনিয়নের ৬নং ওর্য়াড যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রফিকুল ইসলামের বাড়িঘর ভাঙচুর ও ১৭ বিঘা মাছের ঘের লুটপাট চালিয়েছে শিপন কাজী ও তার সহযোগীরা। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে এলাকায় থাকতে পারলেও বর্তমানে আমি পরিবার নিয়ে ঘরছাড়া। অথচ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে শিপন কাজীর সাথেই রাজপথে আন্দোলন করেছি। শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়িয়ে এখন বিএনপির লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছেন তারা। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।’
আওয়ামী লীগ কর্মী দাউদ, গিয়াস ও সোহেল রাতারাতি বিএনপি হয়ে যাওয়ার শেল্টারদাতা শিপন কাজী। জমির প্রকৃত মালিকদের হারির (লিজ) টাকাও দেয়নি। হামলার ভয়ে কেউই প্রকাশ্য মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বহরবুনিয়া ইউনিয়নের রিপন তালুকদার চেয়ারম্যানের ৮০ বিঘা, মিলন তালুকদারের ১০০ বিঘা, আলি ফরাজী ৬০ বিঘা, রফিকুল ফরাজী ৫০ বিঘা, মামুন শেখ ৪০ বিঘা, মাসুদ ৮০ বিঘা তরিকুল ইসলাম গোলাপের ১০০ বিঘা, বয়াসিংগার মোস্তফার ২২ বিঘা এবং রুম্মানের ৬৫ বিঘা মাছের ঘের লুটপাটসহ দখল করে নিয়েছে শিপন কাজীর অনুসারীরা।
বহরবুনিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম, কৃষকদলের আহ্বায়ক মাসুম হাওলাদার, সাবেক ছাত্রদলের সভাপতি নাজমুল ইসলাম রাকি’র নেতৃত্বেই এসব ঘের দখল হয়েছে।
এছাড়া রারইখালি ইউনিয়নে সুমনের ৩০ বিঘার ঘের জোর করে দখল নেয়ার অভিযোগ উঠেছে শিপনের অনুসারী রিপন খান ও কামাল খানের বিরুদ্ধে। তবে হামলার ভয়ে এসব ঘের মালিকলরা মুখ খুলতে বা থানায় অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন। এছাড়াও মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলায় বেশিরভাগ ঘেরই বর্তমান দখল হয়ে গেছে। আবারও অনেকেই চাহিদা মত টাকা দিয়েও এলাকা ছাড়া।
এদিকে, শিপন কাজী মোবাইলে ফোনে ২০ লাখ টাকা চাঁদা ও মাসিক মাসোহারা দাবি করেছেন গ্রিসের বাঙালি কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক এবং ‘জাহিদ ইসলাম’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা জাহিদ ইসলামের কাছে। তার রেকর্ড রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে।
জাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমি দুই দশক ধরে গ্রিসে থাকি। কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। গ্রিসের একটি বাঙালি কমিউনিটির সাধারণ সম্পাদক দায়িত্বে থাকায় নানা অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন শিপনের অনুসারীরা। অথচ বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র নেতাদের সাথেই আমার বেশি ছবি রয়েছে।’
জাহিদ জানান, বর্তমান প্রধান উপদেষ্টার সাথেও বৈঠক করেছেন তিনি। আর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, বাগেরহাট, মোড়েলগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
জাহিদ ইসলাম বলেন, ‘শিপন কাজীর ভয়ে দেশে এসেও অসুস্থ বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে পারিনি। সর্বশেষ আব্বা-আম্মার দোয়া মাহফিলের খাবারও ফেলে দিয়েছে। তাকে মোবাইলে ফোনেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। ঘটনাটি বাগেরহাটের এসপিকে জানিয়েও প্রতিকার পাইনি। পরে এসব অভিযোগ লিখিতভাবে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জমা দেয়া হয়েছে।’
মোড়েলগঞ্জ উত্তর সুলতাড়ী শফিজউদ্দিন দাখিল মাদরাসায় ১৪ লাখ চাঁদাবাজির অভিযোগ ও হামলা ঘটনায় শিপন কাজীসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মাদরাসার সুপার এম জহিরুল আলম। ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর বাগেরহাট জেলা জজ আদালতে এই মামলা করা হয়েছে। জহিরুল আলমের কাছে চাঁদা দাবি ও মারার হুমকি দেওয়ার কলরেকর্ড প্রতিবেদকের হাতে রয়েছে।
স্থানীয় বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, জিউধারা ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর বাদশা ও শিপন কাজী সম্পর্কে বেয়াই। তার চাচাতো ভাই যুবলীগ নেতা কাজী সাইফুজ্জামান রাসেল। এদের হাত ধরেই আওয়ামী লীগের মতিউর রহমান বাচ্চুসহ অনেকেই এখন বিএনপিতে যোগ করেছেন। নব্য বিএনপির দাপটে অনেক সিনিয়র নেতারা চুপ হয়ে গেছেন। অথচ ওয়ান ইলেভেনের সময় থেকেই আওয়ামী লীগের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন শিপন। খালেদা জিয়াসহ বিএনপির নেতারা জেলে থাকলেও তিনি ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে বাড়িতে আসতেন। সামনে-পেছনে পুলিশ র্যাবের গাড়ি থাকতো। অবশ্য তারা এও বলেন, সারাদেশে চাঁদাবাজি-দখলের বিরুদ্ধে হাইকমান্ড ব্যবস্থা নিলেও শিপনের বিরুদ্ধের অভিযোগ থাকলেও অদৃশ্য শক্তিতে তা আটকে যায়।
মোড়েলগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মতলুবুর রহমান বলেন, এই এলাকায় দখল-বেদখল চলে। কিছু অভিযোগ শুনেছি। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি ব্যবস্থা নেব।’
শিপন কাজীর দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগের সত্যটা স্বীকার করেছেন বাগেরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আকরাম হোসেন তালিম।
তিনি বলেন, ‘দপ্তর থেকে তদন্ত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আমরা শিপন কাজীকে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছিলাম। কিন্তু কী কারণে হাইকামান্ড ব্যবস্থা নেয়নি তা জানি না।’
জেলা বিএনপির সমন্বয়ক এম এ সালাম বলেন, ‘মোড়েলগঞ্জের দুই-একটা অভিযোগ আসছিল। আমি বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
বিএনপির গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম বলেন, ‘যারা চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ও দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অভিযোগের বিষয়ে বাগেরহাট জেলা বিএনপির সদস্য খায়রুজ্জামান শিপন বলেন, 'কোথাও আমার একটাও মাছের ঘের নাই। আওয়ামী লীগের আমলে বিএনপির লোকজনের ঘের দখল হয়েছিলো সেগুলো বিএনপি ও সাধারণ মানুষ উদ্ধার করেছে। এখানে আমার বিন্দুমাত্র সম্পৃক্ততা নাই। একটা কুচক্রী মহল আমার বিরুদ্ধে রাজনীতিতে অবস্থান নিতে না পেরে এগুলো প্রচার করছে।
তিনি আরো বলেন, ‘সামনে আমি নমিনেশন চাইবো। বিএনপির আরেকটা গ্রুপ আছে যারা এলাকায় যায় না, কাজ-কাম করে না, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তারা বিএনপিকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে নীলনকশায় নামছে। তারা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা রটাচ্ছে ও ষড়যন্ত্র করছে।'
মাদরাসার সুপারের কাছে চাদাঁ দাবি ও তাকে হুমকি দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, 'এই মাদরাসায় আমার বাপ-দাদাদের ২০ বিঘা সম্পত্তি দেয়া। আমার দাদার নামে মাদরাসা। মাদরাসার প্রধান ওলামা লীগের সদস্য। প্রভাব খাটিয়ে টাকার বিনিময়ে অবৈধভাবে আওয়ামী লীগের লোকজনকে নিয়োগ দিয়েছে। মাদরাসা শেষ করে দিয়েছে এখন কোনো ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় না।'
প্রবাসী জাহিদের বাড়িতে হামলার প্রসঙ্গে শিপন কাজী বলেন, 'তারা নিজেরা বাড়িতে হামলা করে বিভিন্ন মিডিয়ায় নিউজ করেছে। এর সাথে আমি কোনোভাবে সম্পৃক্ত নই।'
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘পাওয়া অভিযোগপত্রগুলো আমি হাইকমান্ডে পাঠিয়েছি। তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই চলছে। ইতোমধ্যে শিপন কাজীকে শোকজ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি জানান, দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে চাঁদাবাজি ও দখলবাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।