খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ঘিরে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা আওয়ামীপন্থি একটি চক্র সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে অর্থ লোপাট করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যার প্রতিবাদ করায় তৈরি হয়েছে গ্রুপিং। এমন জটিলতায় শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে এমন অস্থিরতায় চলতি বছর শিক্ষার্থী ভর্তিও কম হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর ১৮ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের মধ্যে ছয়জন ট্রাস্টি আত্মগোপনে চলে যান। তার মধ্যে রয়েছেন খুলনার সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, বাগেরহাট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুন নাহার, খুলনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেন, এস এম কামাল হোসেনের স্ত্রী মিসেস নূরানী আক্তার, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা খন্দকার বজলুল হক। পালিয়ে থাকলেও তাদের অদৃশ্য ইন্ধনে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। গত ২১ মে ট্রাস্টি বোর্ডের বৈধ চেয়ারম্যানের সই নকল করে সভা ডেকে নিজেকে চেয়ারম্যান দাবি করেন মিজানুর রহমান নামের একজন।

সূত্র আরও জানায়, ৫ আগস্টের পর বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্যপদে থাকা আওয়ামী লীগ নেতারা নিষ্ক্রিয় থাকায় ২০২৪ সালের ২২ আগস্ট বোর্ডের ৬৬তম সভায় সর্বসম্মতিক্রমে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সিরাজুল হক চৌধুরীকে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়। পরবর্তীসময়ে বোর্ড পরিচালনার স্বার্থে ট্রাস্টি বোর্ডের শূন্য তিনটি পদে মো. মিজানুর রহমান, হাফিজুর রহমান এবং ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই সদস্য মো. আজিজুল হক সদস্য হন। নিয়ম অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হতে যৌথ মূলধনী কোম্পানি থেকে নিবন্ধন প্রয়োজন হয়। কিন্তু নতুন তিনজনের ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
‘৫ আগস্টের পর ১৮ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের মধ্যে ছয়জন ট্রাস্টি আত্মগোপনে চলে যান। তার মধ্যে রয়েছেন খুলনার সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, বাগেরহাট-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুন নাহার, খুলনা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেন, এস এম কামাল হোসেনের স্ত্রী মিসেস নূরানী আক্তার, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা খন্দকার বজলুল হক। পালিয়ে থাকলেও তাদের অদৃশ্য ইন্ধনে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়।’
সূত্রের তথ্যমতে, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সিরাজুল হক চৌধুরী ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পর ইউনিভার্সিটির সব আর্থিক বিষয়ে অডিট করাতে চান। তখন কৌশলে বাধা দেন ট্রেজারার কানাই লাল সরকার। ট্রাস্টি বোর্ডের নতুন সদস্য হাফিজুর রহমান এবং মিজানুর রহমানের মাধ্যমে কানাই লাল সরকার আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শে কাজটি সুকৌশলে করান। এরপর ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক চৌধুরী দেশে না থাকার সুযোগে তার সই জাল করে গত ২১ মে ট্রাস্টি বোর্ডের সভা ডেকে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন মিজানুর রহমান। সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে করা হয় সদস্য সচিব। ১৯ জুন ‘পরিকল্পিত মব’ তৈরি করে ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সাহিদা খানমকে অবরুদ্ধ করে রাখে শিক্ষার্থীদের একাংশ। চারঘণ্টা পর সেনাসদস্যরা তাকে উদ্ধার করেন। এরপর ২৪ জুন মবের বিরুদ্ধে এবং রাজনীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীদের অপর অংশ। এ ঘটনায় ২৫ জুন সোনাডাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সাহিদা খানম।
অভিযাগ রয়েছে, মিজানুর রহমান ও হাফিজুর রহমান নিজেদের চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিব ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় দখলে রেখেছেন। চাপ দিয়ে বিজ্ঞাপন, ভর্তি-সংক্রান্ত মার্কেটিংয়ের কাজসহ বিভিন্ন সভার নামে লাখ লাখ টাকা তছরুপ করছেন। ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার কানাই লাল সরকার এসব কাজে ইন্ধন দিচ্ছেন। কানাই লাল সরকার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ মোল্লা গ্রেফতার হওয়ার পর নিয়মিত জেলগেটে তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে কানাই লাল সরকার নিজেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখে ভবিষ্যতে আওয়ামী নেতাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় কালক্ষেপণ করছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউনিভার্সিটির একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘গাড়ি চালাতে গেলে যেমন ড্রাইভিং জানতে হয় তেমনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ট্রাস্ট পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হলে সে বিষয়ে জানতেও হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী লীগ আমলে প্রতিষ্ঠিত। প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে এখানে ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগপ্রাপ্ত। তারাও আওয়ামীপন্থি। এখনো প্রতিটি ধাপে ধাপে তাদের লোকজন ইউনিভার্সিটি নিজেদের আয়ত্ত্বে রাখার চেষ্টা করছেন।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘মিজানুর রহমানের কথা না শোনাতে মব তৈরি করে রেজিস্ট্রারকে পদত্যাগ করানোর কৌশল অবলম্বন করা হয়।
‘গাড়ি চালাতে গেলে যেমন ড্রাইভিং জানতে হয় তেমনি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ট্রাস্ট পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হতে হলে সে বিষয়ে জানতেও হয়। খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি আওয়ামী লীগ আমলে প্রতিষ্ঠিত। প্রেসিডেন্টের (রাষ্ট্রপতি) মাধ্যমে এখানে ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগপ্রাপ্ত। তারাও আওয়ামীপন্থি। এখনো প্রতিটি ধাপে ধাপে তাদের লোকজন ইউনিভার্সিটি নিজেদের আয়ত্ত্বে রাখার চেষ্টা করছেন।’
এ বিষয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সচিব হাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বৈধ চেয়ারম্যানের অনুমোদনে সদস্য হয়েছি। বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। প্রায় চার হাজার শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ এ ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি চাই প্রতিষ্ঠানটি সুন্দরভাবে পরিচালিত হোক।’

তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমি পাঁচটি সভায় অংশ নিয়েছি। সেখানে অনেক সদস্যকে নিষ্ক্রিয় দেখেছি। মিটিংয়ে অংশ নিতে কিংবা আমার কোনো কাজে আমি বাধার সম্মুখীন হইনি। ইউনিভার্সিটির কাজ নিয়ে এবং টেন্ডার নিয়ে একটা গুজব তৈরি হয়েছে। এক কোটি টাকা ঘিরে। কিন্তু এ ধরনের অর্থ তছরুপের কোনো ঘটনা নেই।’
জানতে চাইলে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান দাবিদার মিজানুর রহমান বলেন, ‘ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বেশিরভাগ সদস্য ফ্যাসিস্টের দোসর। আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলায় তাদের চুরি ধরা পড়ে যাবে বলে ভয়ে মিথ্যা অভিযোগ আনছে।’
তিনি বলেন, নতুন ভবনের ডিজাইন করার জন্য আর্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ইউজিসি আমাদের ট্রাস্টি হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। যৌথ মূলধনী কোম্পানিতে অডিট রিপোর্ট জমা দিলে নিবন্ধন হয়ে যাবে। কারও সই জাল করার ঘটনা ঘটেনি বলেও দাবি করেন তিনি।
এ বিষয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ক্যাম্পাসে ভবনের ডিজাইনের জন্য একটি আর্কিটেকচার ফার্মকে এক কোটি টাকা বিল দিতে হবে বলে দাবি করেন মিজানুর রহমান। টাকার অংক অস্বাভাবিক বলে আমি আপত্তি করায় বিরোধ শুরু হয়। এছাড়া হাইকোর্টের মামলা খাতে, জমির দলিল তোলার নামে, পহেলা বৈশাখ উদযাপনে, কারণে-অকারণে আপ্যায়নে, বোর্ড মিটিংয়ের নামে লাখ লাখ টাকার ভুয়া ভাউচার করা হয়। যারা এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন তাদের সবাইকে ‘দোসর’ আখ্যা দিয়ে পরিকল্পিত মব সৃষ্টি করে হটানো হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ২০ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তারা।
কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার সাহিদা খানমের সঙ্গে। মব তৈরি করে গত ১৯ জুন তাকে পদত্যাগ করানোর জন্য একটি মহল কৌশলে চাপ দেয় বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আমি পদত্যাগ করিনি। মূলত অবৈধ কাজে সম্মতি না জানানোতে আমার বিরুদ্ধে এমন চক্রান্ত করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। বর্তমানের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি অবগত না।’

এ বিষয়ে ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য কানাই লাল সরকার জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি গ্রুপ নিজেদের চেয়ারম্যান দাবি করছেন। এ সমস্যা নিরসনে ইউজিসির সিদ্ধান্ত জানতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ইউজিসি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি।
আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে দেখা করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার বাড়ি মাদারীপুর। শাহাবুদ্দীন আহমেদ মোল্লার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরা রাজনীতি করতে না, ভালো কিছু করতে এসেছি। একজনের সঙ্গে অন্যজনের পরিচয় থাকতেই পারে একই শহরে থাকলে। এখন খুলনা থাকি। খুলনার মানুষের সঙ্গে তো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।মিজানুর রহমান ও শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে কানাই লাল সরকার বলেন, মিজানুর রহমান সাহেব ক্যাম্পাসে আসেন, নিয়ম অনুযায়ী সহযোগিতা করছেন। কিন্তু অন্যজনকে খুলনাতে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতির কারণে এবার ছাত্র ভর্তি কিছুটা কম হয়েছে। তবে সামনে আরও শিক্ষার্থী ভর্তি হবে বলে আশা করা যায়।